শব্দের মনস্তত্ত্বঃ রাজপুরুষ বনাম প্রজা -১

শৈশবের বাংলা বিষয়গুলোতে বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে শব্দ গঠন ও নতুন শব্দ জানার স্তরে একটি জিনিষ অবশ্য পাঠ্য ছিল। তা হলো বিপরিত শব্দ। প্রিয় পাঠক, আসুন শৈশবের সেই বিপরীত শব্দগুলো, আরেকটু ঝালিয়ে নিই। বলুন দেখি, চোরের বিপরীত শব্দ কি? পুলিশ, ঠিক ধরেছেন। এবার বলুন দেখি, সৎ এর বিপরীত শব্দ কি? ঠিক বলেছেন অসৎ। আচ্ছা এবার বলুন, রাজা শব্দটির বিপরীত শব্দ কি হবে? যারা ভাবছেন রাণী, তাদের বলি, এটা লিঙ্গান্তর নয় কিন্তু! আর যারা ভাবছেন, প্রজা – তারা ঠিকই বলেছেন, তারা ১০০ তে ১০০।

শব্দ নিয়ে খেলার এবারের শব্দ হলো, পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ। এর অর্থ কি? গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, কোন ***** এই শব্দার্থ বানিয়েছে? এখানে রাজা কে?

Read more: শব্দের মনস্তত্ত্বঃ রাজপুরুষ বনাম প্রজা -১

এখানে লক্ষনীয় শব্দটা হচ্ছে প্রজা। তো দেশে যদি প্রজা থাকে, তাহলে রাজা-ও থাকতে হবে। নাহলে প্রজা শব্দটি শুধু বৃটেনের মতো দেশে থাকতে পারে যেসব দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজবংশ লালন পালন করা হয়, কিন্তু নির্বাহী ক্ষমতা থাকে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে। আমাদের দেশে তো রাজ বংশ নেই। তাহলে রাজাও নেই, প্রজারও থাকার কথা নয়। সকল ভূমির মালিক হবে রাষ্ট্র এবং জনগণ একটি নির্দিষ্ট হারে ভূমিকর (খাজনা নামে পরিচিত) দিয়ে সেই ভূমি ভোগ-দখল এবং বিক্রি করতে পারবে – এরকম একটি আইন জারি করা হয় পাকিস্থান শাসনামলে, ১৯৫০ সালে, যার বাঙলা নাম, প্রজাস্বত্ত আইন (সংক্ষেপে) আর ইংরেজিতে হলো THE STATE ACQUISITION AND TENANCY ACT, 1950। দেখুন দেখি, টিনেন্ট শব্দটির মানে কেন প্রজা করা হলো? এখানে প্রজা কে? কেন, আপনি, আমি সাধারণ মানুষ, দরিদ্র মানুষ। মূল প্রশ্নটি হলো প্রজা কেন ব্যবহার করা হলো? এর দুটো সম্ভাব্য উত্তর আমি খুঁজে পেয়েছি। একটি হলো, দীর্ঘ ২০০ বছরের শাসনামলে বৃটিশ শাসকগোষ্ঠি সাফল্যের সাথে আমাদের মস্স্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছে, তারা শাসক আর আমরা নেটিভ, যেটা আসলে প্রজা অর্থে তারা ব্যবহার করত। পাকিস্থান স্বাধীন হবার পর এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন কবার পরও, যারা আইন প্রনয়ন করেন, তারা নিজেদের অজান্তেই বৃটিশ শাসকগোষ্ঠির স্তরে নিজেদের রেখে আর সকলকে নেটিভ বা শব্দভেদে প্রজা স্তরে নামিয়ে দিয়েছেন। আরেকটি কারণ হতে পারে, তারা কাজটি অজান্তে করেননি, করেছেন জেনেশুনেই, যেন কাগজে কলমেই জনগণ প্রজা হিসেবে থাকে।

সুতরাং পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ – এর অর্থ যদি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, এটা মেনে নেই, সাথে সাথে এটাও আমাকে মেনে নিতে হয়, প্রজা হবার গ্লানি।

ব্যকরণে বাক্যের ভুল আলোচনায় একপ্রকার ভুল বাক্য পাওয়া যায়, সেটাকে বলে, গুরুচন্ডালী দোষে দুষ্ট বাক্য। উদাহরণে বলা ছিল, গরুটি আকাশে উড়িতেছে। এখানে কর্তা, ক্রিয়া পদ, কাল সবই ঠিক আছে কিন্তু বাক্যটি একটি অসম্ভব অর্থ প্রকাশ করছে।

আমাদের মহান সংবিধানে একটি বাক্য আমার নজরে এসেছে, যেটি গুরুচন্ডালী দোষে দুষ্ট। বাক্যটি হলো, জনগণ-ই এই প্রজাতন্ত্রের মালিক। আমরা তো প্রজা। আমাদের ভূমির মালিক রাষ্ট্র। এখানে হু ই জনগন? বাক্যটি অন্য যেকোন বাক্য হতে পারত যেমন: জনগণ-ই এই ভূখন্ডের মালিক – বা সেই জাতীয় কিছু।

প্রজা কিভাবে মালিক হয়?

আরেকটি তথ্য আপনাদের জন্য তুলে ধরি। কেমন লাগে, ধাক্কা খান কিনা, জানালে খুশী হবো। তথ্যটি হলো: জানুয়ারী, ২০১১ সালে, বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের ১৩তম সংস্করণে অন্য একটা শব্দ খুঁজতে গিয়ে, হঠাৎ দেখলাম, রাজপুরুষ শব্দের মানে কি। আপনি বলুন তো রাজপুরুষ শব্দটির মানে কি? হয়ত ভাবছেন, রাজার উত্তরাধিকারী বা সেই ধরনের কিছু। উক্ত অভিধানের ১০২৭ পৃষ্ঠায়, রাজপুরুষ শব্দের অর্থ যেভাবে দেয়া আছে হুবহু ছবিটাই তুলে দিলাম। দেখুন, ধাক্কা খান এবং ধাক্কা খান কিনা, জানান।

কেউ বলতে পারেন – কবে দূর হবে এই রাজা-প্রজা সম্পর্ক?

কবে দূর হবে এই মানসিকতা?

প্রথমে ফেসবুক নোটস আকারে লিখা হয়, ২০১৪ সালে। এখানেঃ https://www.facebook.com/notes/10159426968008538/

Author: ANM Farukh

I am an Analyst.

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.